পাবনা জেলা শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে জোয়ার্দাহ গ্রাম। সেই গ্রামের নিরীহ-আলবোলা হতদরিদ্র বেকার যুবক আবদুল লতিফ চাষাবাদের মাধ্যমে ভাগ্যকে জয় করে জিতে নিয়েছে সমাজের মানসম্মান আর বিত্ত বৈভব। আবদুল লতিফ এখন অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন নিয়ে। কথা হয় তার সঙ্গে জীবন পাল্টে ফেলার গল্প নিয়ে।
প্রশ্ন : আপনি কিভাবে কৃষির মতো একটি পরিশ্রমী এবং শক্ত পেশায় এলেন? এত পেশা থাকতে কৃষি কেন?
উত্তর : আমি ১৯৯৭ সালে বিএ পাসের পর চাকরি খুঁজতে থাকি। হতাশ হয়ে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করি একটি কর্মের আশায় যাতে সংসারে ডাল ভাতের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু বিধিবাম! নিরুপায় হয়ে একজন দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের মাধ্যমে ঢাকা গার্মেন্ট কোম্পানিতে চাকরি নেই, একটানা পরিশ্রম, স্বল্পবেতন, মেচের নিম্নমানের খাওয়া দাওয়া-অবশেষে জন্ডিসে আক্রান্ত। ছয় মাসের চাকরি জীবন ইতি করে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে ফিরি বাড়িতে। আবার দুই চোখে অন্ধকার, সন্ধান করতে লাগলাম একটি কর্মের। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধান পেলাম যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে কৃষি, হাঁস-মুরগি ও কম্পিউটার বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিলাম কৃষি, মৎস্য ও গবাদিপশুর ওপর তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেবো। সে মোতাবেক ভর্তি হয়ে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে নিয়মিত ক্লাস অনুসরণ করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকলাম। প্রশিক্ষণ আর স্যারদের বক্তৃতায় আমার হতাশা আর ঘোর কেটে যেতে লাগল। নতুন আলোর স্পর্শে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। প্রশিক্ষণ শেষ করে বাবার রেখে যাওয়া মাত্র ২ বিঘা অনুর্বর জমিতে পেঁপে আর কলা চাষ শুরু করলাম। আমি কৃষি বিভাগ, প্রাণিসম্পদ বিভাগ এবং মৎস্য বিভাগসহ সর্বত্র যোগাযোগ করতে লাগলাম। উদ্দেশ্য হলো কিভাবে কোন ফসল চাষ করলে আরও লাভবান হওয়া যায়। ধূসর মাটির বুকে যে এত সোনা থাকে জানতাম না। তৈরি করলাম কম্পোস্ট হিপ, জৈবসারের ভা-ার। কৃষি তথ্য সার্ভিস হতে বিভিন্ন ফল সবজি আবাদের ফোল্ডার, বুকলেট জোগাড় করে আর কৃষি বিভাগের পরামর্শ মোতাবেক এবার শুরু করলাম ১০ বিঘা জমিতে কলা পেঁপে আর সবজি আবাদ। ঝড়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেবার প্রায় আট লাখ টাকা লাভ করি। সেই থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আমার। অন্য পেশার কথা আর ভাবনায় আসেনি।
প্রশ্ন : আপনি বর্তমানে কত বিঘা জমিতে কী কী ফল, সবজি আবাদ করেছেন এবং উৎপাদিত ফল সবজি কোথায় বিক্রি করেন?
উত্তর : বর্তমানে আমার ১০ বিঘা জমিতে লিচুর বাগান আছে, ৫ বিঘা জমিতে পেঁপে, ৫ বিঘায় কলা, ৫ বিঘায় অন্যান্য সবজি, নিজের বসতবাড়ি ২ বিঘার ওপর, সেখানেও পরিকল্পিতভাবে আমি শাকসবজি আবাদ করি এবং গাছ আলু বাড়ির বেলগাছ, আমগাছ আর কদবেল গাছে তুলে দিয়ে ফলের পাশাপাশি বাড়তি আয় করি। ১০টি লিচু গাছও আছে বাড়িতে। আতা, শরিফা, লেবু, কাঁঠাল, আমড়া, কামরাঙা ফলের গাছও আছে বাড়িতে। ফল সবজি স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করি। আমি বাড়িতে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করেছি। নিজে রান্না করি এবং নিজের বাড়ির লাইন থেকে প্রতিবেশীর বাড়িতে লাইন দিয়ে সেখান থেকেও মাসিক ১ হাজার টাকা আয় করি। সব মিলে বছরে প্রায় ৮-১০ লাখ টাকা আয় করছি।
প্রশ্ন : আচ্ছা আবদুল লতিফ সাহেব, আপনি নাকি লিচু গাছের মুকুল বৃদ্ধির নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। বলবেন কি?
উত্তর : হ্যাঁ, কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে লিচু গাছের চিকন শাখা-প্রশাখা কেটে দিতে হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে লিচু গাছের কুশি ওই কাটা জায়গা থেকে বের হয়, ওইসব কুশিতে প্রচুর পরিমাণে মুকুল আসে। এটা নতুন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে আমি ভালো ফল পাচ্ছি। আমার দেখাদেখি অন্যরাও করছে।
প্রশ্ন : আপনি কি শুধুই কৃষি কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন?
উত্তর : আমি আমার কাজের ফাঁকে বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করি। স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, গ্রামের স্যানিটেশন পদ্ধতি উন্নত করা, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সাথে থেকে শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থাসহ নানাবিধ কাজে জড়িত।
চেষ্টা, পরিশ্রম আর একাগ্রতার মাধ্যমে ভাগ্য বদলের এক সফল উপাখ্যানের নায়ক জোয়ার্দাহ গ্রামের আবদুল লতিফ। কঠোর পরিশ্রম আর সাধনার বিনিময়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন তার স্বপ্নের কৃষি খামার। তার সফলতায় কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে জোয়ার্দাহসহ আশপাশের সব গ্রামে।
এটিএম ফজলুল করিম*
*সহকারী তথ্য অফিসার (অ. দা.), কৃষি তথ্য সার্ভিস, পাবনা